সাধারণতঃ ‘সমাজ’ বলতে নারী ও পুরুষের সমাহারকে বোঝায়। কিন্তু শব্দটির মূলগত তাৎপর্য তা নয়। প্রকৃত অর্থে ‘সমাজ’ বলতে বোঝায়, যেখানে সকলে একই কর্মবন্ধনে, সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে চলেছে- ‘সমানম্ এজতে’। আমরা কখনো কখনো বাসে, ট্রামে, ট্রেনে বহু লোককেই তো একত্রে দেখে থাকি। কিন্তু তা’ সমাজ পদবাচ্য নয়। একটা সর্বজন গ্রাহ্য আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যখন অনেক মানুষ একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় ও তাকে পাবার জন্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখনই তা সমাজ পদবাচ্য। ইংরেজীতে ‘সোসাইটি’ শব্দটি ‘সমাজ’ শব্দের খাঁটি প্রতিশব্দ নয়। সামাজিক অগ্রগতি এক ধরণের সামাজিক কর্মেরই ফলশ্রুতি যেখানে পারষ্পরিক ঐক্যবন্ধন আরও বেশী সুদৃঢ় হয়ে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে চলে।
অতি প্রাচীনকালেও সামাজিক জীবন ছিল কিন্তু কোন দৃঢ় নিবদ্ধ সমাজ ছিল না। সামাজিক জীবনের এই যে দৃঢ় নিবদ্ধতা তা বলতে গেলে কিছু পরিমাণে ক্ষত্রিয় যুগ ও বৈশ্যোত্তর যুগের অবদান। আবার বৈশ্য যুগই শূদ্র বিপ্লবকে ডেকে আনে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না শূদ্রবিপ্লবের অনুকূল পরিবেশ তৈরী হচ্ছে ততক্ষণ কোন সামাজিক চেতনাই তৈরী হয় না – এমন বলা চলে। এখন প্রশ্ন হল- কেমন করে এই সামাজিক চেতনা আনা যেতে পারে?
সামাজিক চেতনা বলতে বোঝায় একটা বিশেষ আদর্শের প্রভাব, যার দ্বারা জনগণের মধ্যে নবজাগরণ ঘটে থাকে। এটা অনেকগুলি উপাদানের ওপর নির্ভর করে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিরাট ব্যষ্টির নেতৃত্ব। সে কারণেই শূদ্র বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুদৃঢ় ব্যষ্টিত্ব। এর অভাবে মজবুত সমাজ কখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না- সামাজিক বিপ্লব তো দূরের কথা। সমাজকে ঠিক পথে পরিচালিত করবার জন্যে তাই দুটি উপাদান মূলতঃ দরকার- একটি মহান আদর্শ, অপরটি বিরাট ব্যষ্টিত্ব। যাঁরা সমাজ সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলেন অথচ ভবিষ্যৎ-ধ্বংসের আশঙ্কা করে ভীত হয়ে ওঠেন তাঁরা এ কথাটা জানেন না যে প্রকৃত অর্থে যা সমাজ তা জগতের বুকে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই এই মুহুর্ত্তে আমাদের প্রাথমিক কর্ত্তব্য হচ্ছে ‘সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের “সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং” মন্ত্রে সমাজ-চেতনার মূল ভাবটা নিহিত আছে। যেখানে সেরূপ কোন মন্ত্র নেই সেখানে কোন আদর্শ নেই আর যেখানে কোন আদর্শ নেই সেখানে জীবন একটা লক্ষ্যহীন যাত্রা মাত্র।
মানব জীবনের অভিব্যক্তি নানান দিকে ঘটে থাকে। জীবনের চলার পথও তাই বহুমুখী। এইসব বহুমুখী কার্য ধারার মধ্যে মানুষের সংস্কৃতিই সমাজের প্রতিচ্ছবিকে বহন করে। এক কথায় মানব জীবনের বহুমুখী অভিব্যক্তির সমাহারকে বলব ‘সংস্কৃতি’। সমাজে গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে মানব-অভিব্যক্তির ধারাগত তারতম্য ঘটতে পারে। যেমন কেউ হয়তো হাত দিয়ে খায়, কেউ বা চামচ দিয়ে, আবার কেউ বা কাঠি (chopstick) দিয়ে, কিন্তু খায় তো সবাই। মানব সংস্কৃতিও তাই এক ও অবিভাজ্য। সুতরাং ওই অভিপ্রকাশসমূহকে হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলমান সংস্কৃতি, ভারতীয় সংস্কৃতি অথবা ইয়ুরোপীয় সংস্কৃতি বলা অবাস্তব। যাঁরা এই সব খণ্ড ভাব সমূহকে পোষণ করে থাকেন তাঁরা মানব সভ্যতার শুভাকাঙ্ক্ষী নন।
বৌদ্ধিক উন্নতির মাধ্যমে জীবনের অভিপ্রকাশকে বাড়ানো যেতে পারে। তথাকথিত অনুন্নত গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতের কোন স্থানই নেই। স্বভাবতই তাদের ক্ষেত্রে জীবনের অভিব্যক্তি তুলনামূলক বিচারে কম। যেখানে অভিব্যক্তির ধারাগুলির সংখ্যা বেশী, বলা যেতে পারে, জাগতিক দিক থেকে সেখানেই সাংস্কৃতিক উন্নতি অপেক্ষাকৃত বেশী। যেখানে জীবনের অভিব্যক্তি জড়াভিমুখী তাকে বড় জোর বলতে পারি ‘কৃষ্টি’ যা সংস্কৃতিরই অংশ বিশেষ। অর্থাৎ অভিব্যক্তির অমার্জিত অভিপ্রকাশই হচ্ছে ‘কৃষ্টি’। আবার জীবনের অভিজ্ঞতার স্থূল ও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তির সমষ্টিগত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে কৃষ্টিগত পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু মানুষের সংস্কৃতি সব সময়ই এক।
সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ও সভ্যতা সমার্থক নয়। জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে যেখানে সংযম রয়েছে, যৌক্তিকতার অভিপ্রকাশ ঘটেছে তাই হচ্ছে সভ্যতা। একটা বাস্তব উদাহরণ নেওয়া যাক্। খাদ্য গ্রহণ করা সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশেরই একটি। যাঁরা যুক্তি দিয়ে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করাকে ক্ষতিকর বলে মনে করেন তাঁরা এর থেকে বিরত থাকেন। এই যে মার্জিত বোধ এটিই সভ্যতারই পর্যায়ভুক্ত। যদিও মানবের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বহুবিধ কিন্তু তার এই বহুমুখী অভিব্যক্তির ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ বা সংযম নাও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিচারে তাদের আমরা উন্নত বললেও বলতে পারি কিন্তু সভ্য বলব না। কাজেই সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষকেই সভ্য বলা যাবে না, যদি তাদের অভিব্যক্তির মধ্যে যৌক্তিকতা, বিচারশীলতা ও সংযমের অভাব থাকে। অনুরূপ ভাবে যাঁরা তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিচারে অনুন্নত তারা সামাজিক বিচারে অনুন্নত নাও হতে পারে। অনেকেই আছেন যারা আদিবাসীদের অনুন্নত বলে মনে করেন। কিন্তু নিরপেক্ষ বিবেচনা এ কথাই বলবে যে জীবনের ন্যূনতম অভিব্যক্তিসমূহের জন্যে তারা সাংস্কৃতিক ভাবে অনুন্নত হতে পারে কিন্তু সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারা অনেকের তুলনায় অনেক বেশী এগিয়ে আছে। সামাজিক দিক দিয়ে তারা অধিকতর প্রগ্রসর। আফ্রিকানদের সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য।
প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে। সংগ্রামই জীবনের মূলমন্ত্র। যাঁরা নিরস্ত্রীকরণের কথা বলে’ চীৎকার করে তারা আসলে মানব সমাজের শত্রু। এমনকি তাঁরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেও অনিচ্ছুক। এটা অবশ্য সত্য, সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিরস্ত্রকে ও দুর্বলকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু এ জগতে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের সভ্য বলে’ মনে করেন কিন্তু নির্মমভাবে অসহায় ও নির্দোষকে ধ্বংস করেন। হিরোসিমা ও নাগাসাকির মর্মান্তিক ধ্বংসকাণ্ড তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্রের আদিম বর্বরতার স্বাক্ষরই বহন করে। যদিও তারা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অগ্রণী কিন্তু সভ্যতার দিক দিয়ে তারা সম্পূর্ণ অনুন্নত। তাদের ভারতীয় আদিবাসীদের চরণে এসে সভ্যতা শেখা উচিত। যারা আজ এটম ব্যোম ও হাইড্রোজেন ব্যোমের অধিকারী তাদের এই শিক্ষাই দেওয়া উচিত যে এই বিশ্ব মানুষের জন্যেই- দানবের জন্যে নয়। তাদের বিরুদ্ধে মানুষের মাথা তুলে ধরার জন্যে আরও বেশী শক্তিশালী অস্ত্র আবিস্কার করতে হবে।
বর্ত্তমানে সমাজ ও সভ্যতার বিশেষ যত্ন নেওয়া দরকার। বৌদ্ধিক উন্নতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক প্রগতি ঘটাতে হবে। এজন্যে সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিচারপ্রবণতা ও সংযমকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। আজকের দিনে মানুষের জীবনে এই গুণগুলির সম্পূর্ণ অভাব রয়ে গেছে। সর্জনমূলক আদর্শের দ্বারা ও সভ্যতার প্রসারের মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু মানব সমাজ তৈরী করা এই বিশ্বের নেতাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। যদি তা করা হয় তবে সাংস্কৃতিক প্রগতি অনিবার্যভাবেই সম্ভব হবে।
-শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (অভিমত-ষষ্ঠ খণ্ড থেকে সংগৃহীত)